মঙ্গলবার ০৩ ডিসেম্বর ২০২৪
সম্পূর্ণ খবর
AM | | Editor: গৌতম রায় ২২ জুন ২০২৪ ১৫ : ৫৮Arijit Mondal
গৌতম রায়: অষ্টাদশ লোকসভা নির্বাচনে শাসক বিজেপি, এনডিএ জুটির মধ্যে দিয়ে ক্ষমতার রাস ধরে রেখেছেন। কিন্তু বিগত দুটি লোকসভা নির্বাচনে বিজেপি এককভাবে সংখ্যাগরিষ্ঠতা অর্জন করেছিল। এককভাবে সংখ্যাগরিষ্ঠতা অর্জন করার ফলে, আরএসএসের রাজনৈতিক সংগঠন বিজেপি, যেভাবে তাদের হিন্দুত্ববাদী রাজনৈতিক দৃষ্টিভঙ্গিকে ,গোটা ভারত জুড়ে লাগু করবার চেষ্টা করে গেছে, তাতে চিরন্তন, সমন্বয়বাদী, বহুত্ববাদী ভারত টিকে থাকবে কিনা --- এই প্রশ্নটাই মানুষের মধ্যে প্রবল হয়ে উঠতে শুরু করেছিল।
বিশেষ করে প্রথম দুই দফার মোদি সরকার যেভাবে ভারতের সহ নাগরিক মুসলমান সম্প্রদায়ের সম্পর্কে রাজনৈতিক, প্রশাসনিক দৃষ্টিভঙ্গি নিয়ে চলেছে ,তাতে একটা আতঙ্কের পরিবেশ তৈরি হয়েছিল। সেই জায়গা থেকেই সাধারণ মানুষের মধ্যে রাজনৈতিক সচেতনতার বোধটা এমনভাবে গত নির্বাচনে কাজ করেছে, যার ফলশ্রুতি হল ; বিজেপি কেন্দ্রে আর একক গরিষ্ঠতা নিয়ে ক্ষমতায় ফিরে আসতে পারেননি।
একক গরিষ্ঠতা নিয়ে মোদির সরকার চালানো ,আর নানা ধরনের আঞ্চলিক দলের সহযোগিতা নিয়ে সরকার চালানো-- দুটোর মধ্যে বিস্তর ফারাক আছে। এটা মনে করবার কোনো কারণ নেই যে, এন ডি এতে চন্দ্রবাবু নাইডু বা নীতীশকুমার ,তারা সংখ্যালঘুর সার্থবাহী কোনো অবস্থান কেন্দ্রীয় মন্ত্রিসভায় গ্রহণ করবে , সেটার জন্যে লড়বেন। এইসব আঞ্চলিক নেতারা ,তাদের নিজের নিজের রাজ্যে র রাজনৈতিক সমীকরণকে মাথায় রেখেই রাজনীতি করেন। জাতীয় স্তরের রাজনৈতিক ভাবনা ঘিরে এদের তেমন কোনো একটা মাথা ব্যথা নেই।
কিন্তু নরেন্দ্র মোদি যদি তার বিগত দুবারের সরকারের মত ভয়ংকর সাম্প্রদায়িক, ফ্যাসিবাদী অবস্থান গ্রহণ করেন ,তাহলে দেশের প্রতিটি রাজ্যের মতই, বিহার এবং তেলেঙ্গানাতেও সাধারণ মানুষের মধ্যে যে ক্ষোভ তৈরি হবে ,সেই ক্ষোভের আঁচ , চন্দ্রবাবু নাইডু বা নীতীশকুমারের উপর অবশ্যই এসে পড়বে ।নিজেদের ক্ষমতা টিকিয়ে রাখবার এই সমীকরণ থেকে মোদিকে উগ্র ধর্মান্ধ অবস্থানের প্রশ্নে, নীতীশ বা চন্দ্রবাবু কিংবা আরো সব ছোট ছোট জোঁট শরিকরা চাপে রাখবে --এ বিষয়ে সন্দেহের কোনো অবকাশ নেই।
মোদির তৃতীয় দফায় সরকার গঠনের পরেই শরিকদের চাপ ঘিরে নানা ধরনের খবর সংবাদমাধ্যমে উঠে আসতে শুরু করেছে। বিগত ১০ বছরে সরকার পরিচালনার থেকে সংসদে বিরোধীদের কিভাবে অবদমিত করে রাখা যায় এইদিকে বিজেপি সবথেকে বেশি নজর দিয়েছিল। যেভাবে একের পর এক বিরোধী সাংসদদের ক্ষেত্রে আচরণ সপ্তদশ লোকসভার অধ্যক্ষ ওম বিড়লা করেছেন, তেমন আচরণ অতীতে, স্বাধীন ভারতে কখনো কোনো অধ্যক্ষ ,বিরোধীদলের সদস্যদের প্রতি করেননি।
তৃণমূলের সংসদ মহুয়া মৈত্রের বিরুদ্ধে ওঠা অভিযোগ কে ঘিরে যে ধরনের রাজনৈতিক বিদ্বেষ মূলক আচরণ গোটা শাসক শিবির করেছে এবং বিশেষ করে লোকসভার অধ্যক্ষ ওম বিড়লা করেছিলেন, তা ভারতীয় গণতন্ত্রের পক্ষে একটি অত্যন্ত নেতিবাচক দৃষ্টান্ত। একজন মহিলা বিরোধী সংসদ ,তাকে আত্মপক্ষ সমর্থনের সুযোগ না দিয়ে, যেভাবে তার সাংসদ পদ খারিজ করা হয়েছিল সপ্তদশ লোকসভায়, সেই ঘটনাটি বিরোধী রাজনীতির মহলে এমন একটা পরিস্থিতি তৈরি করেছিল যে, পরস্পর যুযুধান তৃণমূল কংগ্রেস এবং সিপিআই(এম), মহুয়া মৈত্র কে গায়ের জোরে বহিষ্কার করা নিয়ে প্রায় একই ধরনের রাজনৈতিক বক্তব্য রেখেছিলেন। এমনটা আমরা দেখেছিলাম কংগ্রেস নেতা রাহুল গান্ধীকে বহিষ্কার করা ঘিরেও।
এবারের লোকসভায় প্রথমেই শরিকদলের শিবির থেকে লোকসভার অধ্যক্ষ পদ দাবি করা হয়েছে ।বিষয়টা খবরের কাগজ থেকে জানতে পারা গিয়েছে। বিজেপি শিবির শরিকদের এই দাবি অনেক কষ্টে সামলিয়েছে। কিন্তু জোট সরকার পরিচালনার শুরুতেই অন্ততপক্ষে মোদি বুঝেছেন যে, গত দশ বছর যেভাবে বিরুদ্ধতার স্বরকে অত্যাচারের স্টিমরোলার চালিয়ে তিনি বন্ধ করে দেওয়ার চেষ্টা করেছিলেন ,তেমনটা কিন্তু আগামী পাঁচ বছর যদি তিনি সরকার টিকিয়ে রাখতেও পারেন, করতে পারবেন না ।
'সরকার টিকিয়ে রাখতে পারেন'-- এই কথাটা এজন্যই বললাম যে ,বিরোধী জোট ইন্ডিয়া শিবির থেকে ইতিমধ্যে এই আশঙ্কা প্রকাশিত হয়েছে যে ,এনডিএ র নানা ধরনের নীতিবিহীন সুবিধাবাদী শরিকরা ,অতীতে এআই এ টি এম কের কুমারী জয়রাম জয়ললিতার মত ভূমিকা গ্রহণ করে, ১৩ মাসের বাজপেয়ী সরকারের মত অবস্থা, মোদি সরকারের করবেন কিনা ,সেই আশঙ্কা উড়িয়ে দেওয়া যায় না।
একক ভাবে গরিষ্ঠতা বিজেপিকে এনে দিতে না পারায় মোদির এখন ঘরে বাইরে বিপদ। আরএসএসের সরসঙ্গচালক( প্রধান) মোহন ভাগবত প্রকাশ্যে মোদি র অহংকারী মানসিকতাকে আক্রমণ করেছেন। আরএসএসের যে সাংগঠনিক ভিত্তি এবং আদর্শগত অবস্থান, সেই জায়গা থেকে তারা কখনোই তাদের রাজনৈতিক সংগঠন বিজেপি ,সঙ্ঘের ছত্র ছায়ার বাইরে গিয়ে বেপরোয়া হয়ে উঠবে এটা সমর্থন করতে পারে না।
আরএসএসের বাইরে মোদির কখনো কোনো রাজনৈতিক অস্তিত্ব ছিলনা ।আরএসএসের পরিমণ্ডলের মধ্যে থেকেও বাজপেয়ী সংসদীয় রাজনীতির মধ্যে দিয়ে নিজের একটা পরিচিতি তৈরি করেছিলেন। গুজরাটের মুখ্যমন্ত্রী হওয়ার আগে তেমন কোনো পরিচিতি কিন্তু সঙ্ঘের বাইরে আদৌ ছিল না মোদির।মোদিকে গুজরাটের মুখ্যমন্ত্রী পদে নিয়োজিত করবার প্রশ্নে সেই সময়ের প্রধানমন্ত্রী বাজপেয়ীর কতখানি সম্মতি ছিল আর কতখানি সঙ্ঘের নির্দেশে গুজরাটের মুখ্যমন্ত্রী হিসেবে মোদিকে তখন মেনে নিতে হয়েছিল তাকে, এ নিয়ে একটা সংশয় থেকেই যায়
সেই মোদী যখন ভয়ংকর স্বৈরাচারী ক্ষমতালিপ্সু হয়ে, কার্যত সঙ্ঘকে অস্বীকার করে ,নিজেকে ঈশ্বর পুত্র হিসেবে দাবি করে, সঙ্ঘের বদান্যতায় পাওয়া ক্ষমতাকে ,আমৃত্যু ভোগ করবার অভিপ্রায়ের দিকে এগোতে থাকেন, তখনই কিন্তু বুঝতে পারা যায় যে, কেন আজ সঙ্ঘপ্রধান মোহন ভাগবাত, মৃদু সুরে হলেও মোদির এই অহংকারী ভূমিকার সমালোচনা করছে।
হিন্দুত্ববাদী আদর্শবোধকে প্রসারিত করা সঙ্ঘের আসন্ন শতবর্ষ পূর্তির প্রেক্ষিতে আরএসএসের কাছে খুব গুরুত্বপূর্ণ একটা বিষয় ছিল। মোদী এককরিষ্ঠতা নিয়ে ক্ষমতায় না আসতে পারে, সঙ্ঘের সেই কাজটি যথেষ্ট সংকটের মধ্যে যে পড়ল এ কথা আলাদা করে বলার প্রয়োজন হয় না। শতবর্ষ পুর্তির মাত্র কয়েক মাস আগে এই যে সমস্যাটা আরএসএসের সামনে এলো, সেই জায়গায় অবশ্যই তাদের কাছে প্রধানমন্ত্রী হিসেবে মোদি র দক্ষতার বিষয়কীয় একটা সংশয়ের আবর্তে এসে গেল।
হিটলারী কায়দায় একদলীয় গণতন্ত্রের মধ্যে দিয়ে ,এক দেশ- এক ভোট এইসব শ্লোগানের ভেতর দিয়ে, যুক্তরাষ্ট্রীয় পরিকাঠামোকে ভেঙে তছনছ করে দিয়ে, রাজনৈতিক হিন্দু ভারতের মধ্যে দিয়ে, আরএসএস যেভাবে তাদের রাজনৈতিক সংগঠনের ব্যবহার করে রাষ্ট্রক্ষমতাকে চিরস্থায়ী করবার পথে এগোতে শুরু করেছিল, সেখানে মোদি ,সঙ্ঘ কে অস্বীকার করে কেবল নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করবার যে প্রবণতা প্রকাশ করেছেন ,তা যে বিরোধীদের একত্রিত করেছে ,সাধারণ ভোটারদের প্রভাবিত করেছে, এমনকি যারা বিজেপি ভোটার, তারাও পছন্দ করেনি এই প্রবণতা, এটাই কিন্তু বুঝতে পারা যাচ্ছে মোহন ভাগবতের প্রাথমিক মূল্যায়নের ভেতর দিয়ে।